"হে মোর দুর্ভাগা দেশ"

বিশ্বখ্যাত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অংকের প্রধান অধ্যাপক জি. এইচ.হার্ডি। ১৬-ই জানুয়ারী, ১৯১৩; সুদূর ভারতবর্ষ থেকে কয়েকপাতার হাতে লেখা একটা চিঠি এসে পৌঁছলো তাঁর কাছে। মাদ্রাজের পোর্টট্রাস্ট অফিসে কর্মরত ক্লার্ক; বার্ষিক উপার্জন কুড়ি ডলার, বয়স তেইশ! চিঠির শুরুতে ঠিক এভাবেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন রামানুজন!

কয়েকপাতা শুধু ফর্মুলা লেখা চিঠি জুড়ে; কোনো প্রমান নেই। সকলেই জানেন, প্রমান ছাড়া ফর্মুলা অসম্পূর্ণ।তাহলে! খানিকটা অবাক-ই হলেন তরুণ গণিতবিদ; চিঠিটা সরিয়ে রেখে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পরের দিন, কি মনে হতে আবার চিঠিটা হাতে নিলেন। নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ-ই মনে হলো; আদৌ কি কোনো সত্য লুকিয়ে আছে চিঠি-টায়! ফেলে দেওয়ার আগে একবার কি দেখবেন! 

ডেকে পাঠালেন সহকারী গণিতবিদ লিটিলউড-কে। প্রতিটি ফর্মুলা প্রমান করার জন্য অঙ্ক কষতে লাগলেন দুজনে। পরপর কয়েকটা ফর্মুলা প্রমান হতেই চমকে উঠলেন; প্রতিটি ফর্মুলা নির্ভুল! পরদিন-ই হার্ডি চিঠি লিখলেন সেই ভারতীয় তরুণকে! সেই শুরু! নিয়মিত চিঠি-পত্রের আদান-প্রদান চলতে থাকে! হার্ডি যে শুধু ফর্মুলাগুলোর মূল্যায়ন করেন, তাই নয়... ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পত্রিকাগুলোতে তা প্রকাশ-ও করতে থাকেন নির্দিষ্ট সময় অন্তর! ইতিমধ্যেই হার্ডি অনুভব করতে পারলেন রামানুজনের অপরিসীম দারিদ্র্য; লিখলেন... "এক দরিদ্র হিন্দু তরুণ তাঁর অসাধারণ মেধা নিয়ে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ পন্ডিতদের সাথে লড়াইয়ে নেমেছেন।" প্রতিভাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদেই বোধহয়, হার্ডি প্রথমেই চিঠি লিখলেন ভারতের শিক্ষা বিভাগের কয়েকজন পরিচিত উচ্চ-পদস্থ কর্মচারীর কাছে; তারপর চিঠি লিখলেন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। মূলতঃ, হার্ডির প্রস্তাবেই মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় রামানুজনের গবেষণার জন্য মাসিক ৭৫ টাকার বৃত্তি মঞ্জুর করেছিল! ১৯১৩.... রামানুজনের বয়স তখন পঁচিশ!

 ছোটোখাটো চেহারা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, আদপেই সুদর্শন নন। জন্ম পরাধীন ভারতবর্ষে; হাজার ধর্মীয় গোঁড়ামি, বাধানিষেধ, সামাজিক সংস্কারের ঘেরাটোপে! বাড়ির অবস্থা মোটেই স্বচ্ছল ছিল না! অর্ধেক দিন ভালো করে খাওয়া জুটতো না! এদিকে অঙ্ক ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে মোটেই আগ্রহ পান না! কলেজের প্রথম বার্ষিক পরীক্ষায় পাশ করতে পারলেন না! ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যেটুকু বৃত্তি পেয়েছিলেন, বন্ধ হয়ে গেলো সেটাও! মানসিক হতাশায় বেশ কিছুদিন আর কলেজে গেলেন না। উপস্থিতি কম থাকার জন্য পরীক্ষায় বসা হলো না সেবার-ও! চলে গেলেন মাদ্রাজ ; ভর্তি হলেন সেখানকার এক কলেজে! পরীক্ষার ঠিক আগেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন; সেবার আর পরীক্ষায় বসা হলো না! একটু সুস্থ হতেই আবার পড়াশুনো; ঠিক করলেন, প্রাইভেটে পরীক্ষা দেবেন। কয়েক মাস পর কুম্ভকোনম কলেজ থেকে পরীক্ষা দিলেন; কিন্তু পাশ করতে পারলেন না।সবমিলিয়ে চারবার পরীক্ষা দিয়েছিলেন! তৎকালীন ভারতবর্ষে যে তরুণ গণিতশাস্ত্রে অপ্রতিম ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন, তিনি প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নে ডাঁহা ফেল করেছেন, ভাবতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি! নিতান্তই বাধ্য হয়ে অঙ্কের টিউশনি শুরু করলেন। কিন্তু পড়াতে পড়াতে নিজেই অঙ্কের জটিলতায় হারিয়ে যান, ছাত্রের কথা আর মনে থাকে না।ফলত:, এমন আপনভোলা শিক্ষকের প্রয়োজন ফুরোয় ছাত্রদের কাছেও।এরমধ্যেই মাত্র বাইশ বছর বয়সে বাবা-মা-র ইচ্ছেয় বিয়েতে রাজি হন।সংসারের দায়িত্ব আরো বাড়লো, বাড়লো অর্থের প্রয়োজন! রামচন্দ্র রাও, গণিত সোসাইটির সম্পাদক প্রথম চিনেছিলেন রামানুজনের প্রতিভার স্বরূপ; রামানুজনের জন্য পঁচিশ টাকা মাসোহারার-র বন্দোবস্ত-ও করে দিয়েছিলেন! বেশ কয়েকমাস নিরবিচ্ছিন্ন গবেষণা; ১৯১১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে 'ইন্ডিয়ান ম্যাথামেটিকাল সোসাইটি'-র পত্রিকায় কয়েকটি খন্ডে প্রকাশিত হল এই গবেষণার ফসল! কিন্তু এভাবে বাড়িতে বসে মাসোহারা নেওয়ার ব্যবস্থা বেশিদিন মনঃপূত হলো না রামানুজনের।বাধ্য হয়েই আবার চাকরির অন্বেষণ। শেষমেশ আবার রামচন্দ্রের সুপারিশে-সাহায্যেই পোর্টট্রাস্টের অফিসে ক্লার্কের চাকরিতে যোগদান করলেন রামানুজন; বয়স তখন চব্বিশ! এই চাকরিতে থাকাকালীন-ই হার্ডিকে চিঠি লেখা! 

স্বাভাবিক ভাবেই হার্ডি-প্রদত্ত স্বীকৃতি-তে আনন্দিত-অভিভূত হয়ে পড়েন রামানুজন।গবেষণা-ই তো করতে চেয়েছেন সারাজীবন! ক্লার্কের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পাকাপাকিভাবে প্রবেশ করলেন স্বপ্নের জগতে! হার্ডিকে চিঠিতে জানালেন, "মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে দু-বছরের জন্য বার্ষিক ৬০ পাউন্ডের বৃত্তি মঞ্জুর করেছে।" আর্থিক অসুবিধে মিটলো, কিন্তু সমস্যা দানা বাঁধলো অন্যত্র! প্রথাগতভাবে গণিতের কিছুই প্রায় শেখেন নি রামানুজন! তিনি যে পদ্ধতিতে ফর্মুলা আবিষ্কার করেন, তা তাঁর নিজস্ব পদ্ধতি! অথচ সঠিক পথ না জানলে কোনো তত্ত্ব-কোনো সূত্র-কেই বিদগ্ধ মানুষের সামনে প্রমান করা যাবে না।পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে হার্ডি ইংল্যান্ডে আমন্ত্রণ জানালেন রামানুজনকে। 

দ্বিধাগ্রস্ত রামানুজন! একদিকে সামাজিক কুসংস্কারের বেড়াজাল, পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা, ধর্মীয় অনুশাসন.... অন্যদিকে বিদ্যাচর্চার উন্মুক্ত অঙ্গন, নতুন জগতের হাতছানি! আত্মীয়-পরিজন তো বটেই, রামানুজনের বিদেশ-যাত্রায় সবচেয়ে বড় আপত্তি জানালেন বাবা! কিন্তু শেষমেশ এগিয়ে এলেন মা, অশিক্ষিত; ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অভ্যস্ত সাধারণ মহিলা।ছেলের জটিল গাণিতিক তত্ত্বের কিছুই  বোঝেন না; কেবল যন্ত্রনা বোঝেন; রামানুজনকে অনুমতি দিলেন বিদেশযাত্রার। গণিতজ্ঞ বন্ধুরা তো বটেই, এ-ব্যাপারে রামানুজনকে সবচেয়ে বেশিই সাহায্য করলেন মাদ্রাজ-স্থিত অধ্যাপক নেভিল, হার্ডির কেমব্রিজের বন্ধু; গণিতজ্ঞ। ১৭-ই মার্চ; ১৯১৪ তরুণ রামানুজন রওনা দিলেন ইংল্যান্ডের পথে!

গোটা ইউরোপ জুড়ে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আবহ! এই পরিস্থিতিতে বহু বিজ্ঞান বিষয়ক পত্র-পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলো। অধিকাংশ বিজ্ঞনী-ই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। ফলতঃ, গবেষণায় তেমন কোনো সঙ্গী পাওয়া গেলো না।হার্ডির তত্ত্বাবধানে একা-একাই ফর্মুলা রচনা করতেন রামানুজন, এক-একদিনে ৮ থেকে ১০টা ! হার্ডি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করতেন, প্রতিটি ফর্মুলা-ই একেবারে নির্ভুল! গণিতের দুরূহ তত্ত্ব নিয়ে নিরবিচ্ছিন্ন গবেষণায় কেমব্রিজে কেটে গেলো চার বছর (১৯১৪-১৯১৮)... কিন্তু ইংল্যান্ডের জলহাওয়া ছিল ভিন্নধর্মী; ভারতবর্ষের থেকে একেবারেই আলাদা! মানিয়ে নিতে পারলেন না রামানুজন। ঠান্ডার মধ্যে স্নান, উপবাস, বিভিন্ন ধরণের খাবার গ্রহণে আপত্তি... সব মিলিয়ে শরীর ভেঙে পড়ছিল দ্রুত! হার্ডি দেখা করতে এসেছেন রোগশয্যায়।কথাপ্রসঙ্গে একবার বলেই ফেললেন, যে ট্যাক্সি-তে এসেছেন, তার নাম্বার-টা! যেহেতু সংখ্যা নিয়েই নাড়াচাড়া, অতএব সংখ্যা হিসেবে ১৭২৯ যে একেবারেই আগ্রহ জাগায় না, যোগ করতে ভুললেন না সেটাও। রামানুজন উত্তরে বলেছিলেন, আপাতভাবে দেখে যতটা নীরস লাগছে, সংখ্যা-টা নাকি মোটেও সেরকম নয় ! তার কারণ একটা সংখ্যায়-কে অনেকসময়-ই দুভাবে দু দুটো ঘনের সমষ্টি হিসাবে লেখা যায়, আর ১৭২৯ সংখ্যা-টি নাকি সেই সংখ্যাগুলোর মধ্যে ক্ষুদ্রতম।১২^৩+১^৩ আর ১০^৩+৯^৩.... ভাবা যায়!!!

ত্রাতার ভূমিকায় আবার হার্ডি! হার্ডি বুঝতে পারলেন, এভাবে বেশিদিন চলতে থাকলে রামানুজনকে বাঁচিয়ে রাখা-ই মুশকিল হবে। প্রিয় ছাত্র-সহযোগীকে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করলেন হার্ডি; মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে নির্বাচিত হলেন রামানুজন! ততদিনে রামানুজন লন্ডনে রয়াল সোসাইটির ফেলো মনোনীত হয়েছেন! দেশে ফেরার অল্প কয়েকমাস আগে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের ফেলো হিসেবেও সম্মাননা পেলেন! 

১৯১৯ সালের সাতাশে ফেব্রুয়ারী ভারতবর্ষের পথে রওনা হলেন রামানুজন! চার সপ্তাহ পরে যখন বোম্বাইতে এসে পৌঁছলেন, তখন তিনি গুরুতর অসুস্থ! শরীর ক্রমশই বিছানায় মিশে যাচ্ছে, বত্রিশের তারুণ্য, জীবনীশক্তি, অনন্য মেধা নিভে আসছে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে! জীবনের পড়ন্তবেলাতেও সংখ্যা আর সূত্র নিয়ে যা যা ছেলেখেলা করেছেন, তা দেখে বিস্মিত হার্ডি বলেছিলেন, মৃত্যুশয্যায় শুয়ে রামানুজন যে গবেষণা করে গেছেন, একজন মানুষ সারাজীবনেও সে কাজ করতে পারেন না....

মৃত্যুর প্রায় ছেষট্টি বছর পর তাঁর বিভিন্ন ফর্মুলা সংগ্রহ করে দুটি খন্ডে প্রকাশিত হয়। যদিও অধিকাংশ ফর্মুলার-ই কোনো প্রমান নেই, কিন্তু তাঁর উত্তরকালের গণিতজ্ঞরা গবেষণা শেষ করার পর দেখছেন যে তাঁরা যা আবিষ্কার করেছেন, তা তাদের বহু আগেই রামানুজন নির্ধারণ করে রেখেছেন। বিখ্যাত গণিতবিদ উইলিয়াম গোসপার ১৯৪৫ সালে পাই-এর মান ১.৭৫ কোটি ঘর দশমিক পর্যন্ত নির্ণয় করার জন্য একটি কম্পিউটার অ্যালগোরিদম লেখেন। এর পরেই তিনি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেন, তাঁর গবেষণা লব্ধ ফল রামানুজন কবেই নির্ধারণ করে গেছেন! কিঞ্চিৎ রসিকতা মিশিয়ে গোসপার বলেছিলেন, "যে মানুষটি কবরের তলা থেকে হাত বাড়িয়ে আমাদের সাধনার সুফল কেড়ে নেয়, তাকে কেমন করে ভালোবাসি!" সম্ভবতঃ বিজ্ঞানচর্চার আনখ-সমুদ্দুরে একজন গবেষকের তার পূর্বসূরিকে অর্পিত শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ্য!

আজ ২৬শে এপ্রিল, ২০২০! রামানুজনের চলে যাওয়ার ঠিক একশো বছর! একশো বছর....
একটা গোটা শতাব্দী অতিক্রান্ত! আজ-ও আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা চলছে নিরন্তর... আর করোনা পরীক্ষার জন্য টেস্টকিট আসছে বিদেশের পরীক্ষাগার থেকে! হে মোর দুর্ভাগা দেশ......

Comments

Popular posts from this blog

’মরুবৃক্ষ'

"মনের মানুষ"